কেউ বাড়িতে এলেই হাউমাউ করে কাঁদতেন রিমা বেগম। আর কেউ না থাকলেই আবার স্বাভাবিক। খাওয়া-দাওয়াও আগের মতোই করতেন। নিয়মিত ব্যবহার করা ফোনটি কোথায় জানতে চাইতেই অসংলগ্ন কথাবার্তার শুরু।
এসব বিষয় থেকেই স্ত্রী রিমাকে কিছুটা সন্দেহ করতে থাকেন স্বামী ইসমাইল হোসেন সুজন। তবে কিছু বলার ছিল না। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে দুই শিশু মৃত্যুর বিষয়ে রিমার জড়িত থাকার বিষয়। মূলত পরকীয়া প্রেমিকের সঙ্গে ঘর বাধতেই রিমা তার দুই শিশুকে হত্যা করার মতো ঘটনা ঘটান।
দুই সন্তানকে হারিয়ে প্রতিবন্ধী ইসমাইল হোসেন এখন হতবিহবল। সন্তান হত্যাকারী স্ত্রী রিমার ফাঁসি দাবি করেছেন তিনি। ওই বিচারের ফলে আর কোনো মা যেন এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে সাহস না পান সে কারণে তিনি সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন।
গত ১০ মার্চ ঘণ্টাখানেকের ব্যবধানে মারা যায় মো. ইয়াছিন খান (৭) ও মো. মোরসালিন খান (৫)। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের মো. ইসমাইল হোসেন সুজন ও রিমা বেগম দম্পতির দুই সন্তান তারা। পরকীয়া প্রেমিকের সঙ্গে পরিকল্পনা করে বিষ মেশানো মিষ্টি খাইয়ে দুই সন্তানকে হত্যা করেন মা রিমা বেগম। পুলিশ রিমা বেগমকে গ্রেপ্তারের পর রহস্যের উন্মোচন হয়। গত ১৭ মার্চ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় রিমা। পরকীয়া প্রেমিক মো. শফিউল্লাহকে গ্রেপ্তারে চেষ্টা করছে পুলিশ।
চোখে কম দেখাসহ শারীরিক প্রতিবন্ধী ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘বাইরে থেইক্কা কেউ আইলেই হেই (স্ত্রী) কানতো, ডং করতো। অহন উচিত শিক্কা অইছে। আমি হেইর ফাঁসি চাই। আর কোনো মা জাতে সন্তান মারনের সাহস না দেহাইতারে। ’
তিনি আরো জানান, রিমা বেগম যে চালকলে কাজ করতেন সেখানকার সর্দার শফিউল্লাহর সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে উঠে। রিমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় শফিউল্লাহ। তবে প্রস্তাব দেয় যে দুই সন্তানকে ছাড়া আসতে হবে। এ অবস্থায় দুই সন্তানকে হত্যার পরিকল্পনা করে তারা।
ইসমাইল বলেন, ‘মিষ্টি খাওয়ানের পর আমার আম্মারে কইছে জ্বরের অসুদ আইন্না দিতো। পুলা দুইডার বুলে জ্বর উঠছে। হেই আগে তেইক্কাঅই প্লেন কইরা ইডা করছে। শফিউল্লাহ কইছে পথের কাটা দুই পুলা সরাইতারলে তুমি হইবা রাণী আমি হইবো রাজা। দোস জাইব গা নাপা সিরাপের উফরে দিয়া। ’
মাত্র ১২ বছর বয়সে বিয়ে। স্বামী প্রতিবন্ধী; চোখে দেখেন কম, পায়ে সমস্যা বিধায় চলতেও বিপত্তি। বিয়ের ১৫ দিনের মাথায় বাবার বাড়ি ফিরে যান রিমা। গরিব মানুষ, অন্যত্র বিয়ে দিতে আবার কোথায় টাকা পাবে পরিবার- ইত্যাদি সব বুঝিয়ে রিমাকে স্বামীর বাড়ি পাঠানো হয়। বিয়ের বছর খানেকের মাথায় পুত্র সন্তানের জন্ম দেন রিমা। দু’দিন পর মারা যায় সেই সন্তান। এই কষ্টের পাশাপাশি স্বামীর সেবা যত্নেও রিমা কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। স্বামীর আর্থিক দুরাবস্থাও তাকে ভাবাচ্ছিলো। সংসার জীবনটা বিষিয়ে উঠার কথা আবারো জানায় বাবার বাড়ির লোকজনকে। সবাই আবারো তাকে বুঝিয়ে সব ঠিক হয়ে যাবে বলে আশ্বাস দেন।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সংসারের দিকে ঝুঁক বাড়ে রিমার। ইয়াছিন ও মোরসালিন নামে দুই সন্তান তাদের সংসারে। তবে শারীরিক জটিলতায় আর সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা নেই রিমার। স্বামীর পাশাপাশি নিজেও কাজে যোগ দেন।
সেই রিমা এখন ‘খুনি’। ২৫ বছর বয়সি ওই নারী পুলিশকে জানালেন, শারীরিকভাবে অক্ষম স্বামীর প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়ার কারণে পরকীয়ায় আসক্তি। প্রেমিকের শর্ত-একান্তই তাকে পেতে চায়। সন্তানদেরকে সঙ্গে নিয়ে সে এ সম্পর্ক মেনে নেবে না। এ অবস্থায় প্রেমিকের সঙ্গে পরিকল্পনা করেই দুই সন্তানকে নিজ হাতে বিষ খাইয়ে হত্যা করে। পরে নাপা সিরাপ খেয়ে শিশুদের মৃত্যু হয়েছে বলে অপপ্রচার চালানো হয়।
ঘাতক মা রিমা আক্তারকে আসামি করে ১৭ মার্চ সকালে আশুগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করে শিশুদের বাবা উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের বাসিন্দা ও ইটভাটার শ্রমিক মো. ইসমাইল হোসেন খান সুজন। এর পরই পুলিশ ওই নারীকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আদালতে পাঠায়।
ওই দিন নিজ কার্যলয়ে করা সংবাদ সম্মেলনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আনিসুর রহমান জানান, ঘটনার দিন ১৫ বার শফিউল্লাহ ও রিমার মধ্যে কথা হয়। সেই ফোন কলের সূত্র ধরেই এগুতে থাকে পুলিশ। এরই মধ্যে শফিউল্লাহ কৌশলে রিমার কাছ থেকে মোবাইল ফোনটি নিয়ে যায়। কেননা, যে সিম ব্যবহার করে রিমা কথা বলতেন সেটি ছিল শফিউল্লাহর। মোবাইল ফোনটি কোথায়? বুধবার রাতে রিমার কাছে জানতে চায় শফিউল্লাহ। তখন রিমা অসংলগ্ন কথা বলতে থাকে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়। নানা তথ্য উপাত্ত হাতে পেয়ে রাতেই পুলিশ রিমাকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ধীরে ধীরে রিমা হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করেন।
পুলিশ সুপার জানায়, ওই নারীর প্রতি পুলিশের কঠোর নজরদারি ছিল। লোকজন গেলেই সে ছেলেদের জন্য কান্নাকাটি করতো। কিন্তু এমনিতে বাড়িতে খুব স্বাভাবিক থাকতো। তার খাওয়া-দাওয়া ছিল খুবই স্বাভাবিক। এর পাশাপাশি তার মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে পুলিশ তদন্ত কাজ এগোয়। ঘটনার পর পুলিশ যদি ফোন নিয়ে সব জেনে যায়- সে ভয় থেকে শফিউল্লাহ ফোনটি রিমার কাছ থেকে নিয়ে যান।
এদিকে শিশুদের জন্য যে ফার্মেসী থেকে নাপা সিরাপ আনা হয় সেখান থেকে আটটি নিয়ে পরীক্ষা করে ওষুধ প্রশাসন। তবে পরীক্ষায় কোনোটাতেই ক্ষতিকারক কিছু যাওয়া যায়নি বলে ওষুধ প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়। যে সিরাপ খেয়ে মৃত্যু হয়েছে সেটিও ওষুধ প্রশাসন পরীক্ষা করে দেখছে।
পুলিশ বলছে, ওই দুই শিশুর ভিসেরা রিপোর্টের পাশাপাশি নাপা সিরাপের পরীক্ষার রিপোর্টের জন্য তারা অপেক্ষা করছেন। জবানবন্দি দেওয়া মায়ের কথার সঙ্গে ওই রিপোর্টের মিল থাকে না কি-না সেটিও যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে।