ব্যক্তিপর্যায়ে মোবাইল সিম নিবন্ধনের সীমা আরও কমানোর উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। আইন-শৃঙ্খলাসংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের সাম্প্রতিক বৈঠকে জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে সর্বোচ্চ ৫টি সিম নিবন্ধনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে একজন ব্যক্তি ১৫টি পর্যন্ত সিম নিবন্ধন করতে পারেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের ওই বৈঠকে জানানো হয়, ভুয়া সিম ব্যবহার এবং এর অপব্যবহার রোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে। এজন্য আদালতের অনুমোদনক্রমে অবৈধ সিম বাতিল করার উদ্যোগ দ্রুত নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
বৈঠক সূত্র জানায়, এ বিষয়ে ইতোমধ্যে আইন মন্ত্রণালয় ও ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে উভয় মন্ত্রণালয়কে যৌথভাবে প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া নির্ধারণের নির্দেশ দেওয়া হয়।
কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী, একটি জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে সর্বোচ্চ ৫টি মোবাইল সিম ব্যবহারের সীমা নির্ধারণ করে তা কার্যকর করতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
এছাড়া সভায় মোবাইল সিম নবায়ন ব্যবস্থা চালু করার প্রস্তাবও তোলা হয়। এতে নির্দিষ্ট সময় পর পর ব্যবহারকারীর তথ্য যাচাই করে পুনরায় নিবন্ধনের সুযোগ থাকবে— যার মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় বা ভুয়া সিম শনাক্ত করা সহজ হবে।
একইসঙ্গে, এক এলাকার এজেন্টের নিবন্ধিত সিম যাতে অন্য এলাকায় ব্যবহার না করা যায় সে বিষয়ে নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বৈঠকে আরও বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধর্মীয় উসকানিমূলক বক্তব্য, অবমাননাকর তথ্য বা মিথ্যা প্রচারের বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন পরিচালনা করতে হবে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইট, ভিডিও বা কনটেন্ট দ্রুত অপসারণে টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।
রোববার (২৬ অক্টোবর) আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির ১৫তম সভা শেষে সাংবাদিকদের উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক ঘটনা ঘটে, যা সত্যি নয়। আগে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে অনেক অসত্য সংবাদ পরিবেশন করা হতো। কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যম সত্য তথ্য তুলে ধরার কারণে এটা কিন্তু বন্ধ হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা সিম কার্ডগুলো কমিয়ে আনতে চাইছি। যেহেতু একবারে সব কমানো যাবে না, তো আমরা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আস্তে আস্তে কমিয়ে ফেলবো। সিমের মাধ্যমেই অনেক ধরনের ঘটনা ঘটে। ধরুন এক বোন সিম রেজিস্ট্রেশন করতে গিয়েছেন কিন্তু তার হাতের ছাপ নিয়ে একাধিক সিম রেজিস্ট্রেশন করে নিয়েছে। অবৈধ সব সিম দিয়ে কেউ অপরাধ করলে পরে কিন্তু সিমের মালিককে শনাক্ত করা হয়। সুতরাং এই সিম নিয়ে আমরা কাজ করছি।
উপদেষ্টা আরও বলেন, সিমের ব্যাপার আমরা অনেকভাবে আলোচনা করেছি। আমরা যতটা পারি ব্যক্তিপর্যায়ের সিম নিবন্ধন কমিয়ে আনব। নির্বাচনের আগে সিম নিবন্ধন কমে নিয়ে আসবো। নির্বাচনের পরেও এটা নিয়ে কাজ হবে। এই সমস্যাটা কীভাবে পুরোপুরি সমাধান করা যায় সে বিষয় কাজ চলছে। আমাদের লক্ষ্য ব্যক্তি পর্যায়ে সিম নিবন্ধন কমিয়ে পাঁচটি করা। নির্বাচনের আগে এটা কমিয়ে সাতটিতে নিয়ে আসবো। পরে আরও কমিয়ে পাঁচটি করা হবে। পারলে এটাকে দুটি করবো।
এদিকে একটি জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) মাধ্যমে সর্বোচ্চ ১০টি সিম নিবন্ধনের সীমা পুনর্ব্যক্ত করেছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। কমিশন জানিয়েছে, নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত সিম আগামী ৩০ অক্টোবরের মধ্যে ডি–রেজিস্টার (নিবন্ধন বাতিল) বা মালিকানা পরিবর্তন না করলে, দৈবচয়ন ভিত্তিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল করা হবে।
সম্প্রতি বিটিআরসি এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, গ্রাহকরা তাদের এনআইডিতে নিবন্ধিত সিম কার্ডগুলোর সংখ্যা জানতে পারবেন *16001# নম্বরে ডায়াল করে। এরপর প্রম্পটে জাতীয় পরিচয়পত্রের শেষ চারটি সংখ্যা প্রবেশ করাতে হবে। এতে নিবন্ধিত সব সিমকার্ডের তথ্য পাওয়া যাবে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গ্রাহকরা তাদের নিজ এনআইডিতে পছন্দমতো ১০টি সিমকার্ড রেখে অতিরিক্ত সিমগুলো সংশ্লিষ্ট মোবাইল অপারেটরের কাস্টমার কেয়ার সেন্টারের মাধ্যমে ডি–রেজিস্টার বা মালিকানা পরিবর্তনের আবেদন করতে পারবেন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তা সম্পন্ন না হলে, বিটিআরসির তত্ত্বাবধানে অতিরিক্ত সিমগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল করা হবে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি ও পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা ও সাইবার স্পেসের সুশাসন নিশ্চিত করতে সিম ব্যবহারে শৃঙ্খলা আনা এখন সময়ের দাবি। ভুয়া সিম বন্ধ ও সীমা নির্ধারণের মধ্য দিয়েই এটি শুরু হচ্ছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। প্রতারণা, চাঁদাবাজি, এমনকি নারী নির্যাতনের মতো অপরাধেও মোবাইল সিম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধীরা ভুয়া বা অন্যের নামে নিবন্ধিত সিম ব্যবহার করে থাকে। এতে করে তদন্তে জটিলতা তৈরি হয়, অপরাধী শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
ব্যক্তিপর্যায়ে সিমের সংখ্যা সীমিত করলে অপরাধীদের জন্য সিম অপব্যবহার কঠিন হয়ে পড়বে। এর সঙ্গে যদি সিম নবায়ন (renewal) বা পুনঃনিবন্ধন ব্যবস্থা চালু করা যায়, তাহলে নিয়মিত যাচাইয়ের মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় বা সন্দেহজনক সিম সহজেই বাতিল করা সম্ভব হবে। এতে প্রতারণা ও সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আসবে।
তিনি আরও বলেন, সিম সীমিতকরণ শুধু প্রশাসনিক নয়, নিরাপত্তারও বিষয়। কারণ একজনের হাতে যত বেশি সিম থাকে, তার অপব্যবহারের সুযোগও তত বেশি থাকে।
বিটিআরসির সাম্প্রতিক হিসাব মতে, দেশে সিমের নিবন্ধিত প্রকৃত গ্রাহকের সংখ্যা ৬ কোটি ৭৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৪৫। এর মধ্যে ৮০ দশমিক ৩২ শতাংশ গ্রাহকের নামে পাঁচটি বা তার কম সিম রয়েছে। ৬ থেকে ১০টি সিম রয়েছে ১৬ দশমিক ২৩ শতাংশ গ্রাহকের কাছে। ১১ থেকে ১৫টি সিম ব্যবহারকারী গ্রাহক মাত্র ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক কর্নেল (অব.) কাজী শরীফ উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি সক্রিয় সিম রয়েছে, যা জনসংখ্যার প্রায় সমান। কিন্তু এত বিপুলসংখ্যক সিমের একটি বড় অংশই কার্যত অচল বা অনিয়মিতভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব নিষ্ক্রিয় সিম অনেক সময় অপরাধ চক্রের হাতে পড়ে ব্যবহৃত হয়। ফলে রাষ্ট্রের ডিজিটাল নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ে।
এক্ষেত্রে সরকারের এই সিদ্ধান্ত— একজনের নামে সিম নিবন্ধনের সংখ্যা ১৫ থেকে কমিয়ে ৫-এ আনা— খুবই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। এতে করে সিম ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরে আসবে এবং সাইবার অপরাধের প্রবণতাও কমবে।
তিনি আরও বলেন, আমার মতে, শুধু সীমা নির্ধারণ নয়, সিম বিক্রেতা ও রেজিস্ট্রেশন এজেন্টদের ওপরও কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। কারণ ভুয়া সিমের বড় উৎস হলো নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় অনিয়ম। যদি এই পর্যায়টা পুরোপুরি ডিজিটাল ও বায়োমেট্রিকভাবে সুরক্ষিত করা যায়, তাহলে অপরাধমূলক যোগাযোগ প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনা সম্ভব।