মুক্তিযোদ্ধাকে দাদা সাজিয়ে নাতি কোটায় বছরের পর বছর চাকরি করে গেছেন। যুগ পেরিয়ে গেলেও বহাল তবিয়তে চাকরিতে কর্মরত রয়েছেন। রাজশাহীতে কর আপীল অঞ্চলের সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক-কাম-কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরি নেওয়া ওই ব্যক্তির নাম মো. হিমেল কাওসার।
খোদ রাজশাহী কর অঞ্চলের তদন্ত প্রতিবেদনে এমন অবাক করা জালিয়াতির তথ্য উঠে আসে। শুধু তাই নয়, চাকরি নেওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধা কোটা না থাকলেও অদৃশ্য ক্ষমতায় চাকরি নিয়েছিলেন হিমেল।
রাজশাহী কর আপীল বিভাগ থেকে কর কমিশনার সম্প্রতি এনবিআর চেয়ারম্যান আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চিঠি পাঠিয়েছেন। যেখানে প্রমাণপত্রসহ তদন্ত প্রতিবেদন সংযুক্ত করা হয়েছে। ঢাকা পোস্টের কাছে সংশ্লিষ্ট সব নথি রয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদন ও চিঠি সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ২৬ আগস্ট আব্দুল আউয়াল নামে এক ব্যক্তি মো. হিমেল কাওসারের বিরুদ্ধে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে চাকরি নেওয়ার বিষয়ে অভিযোগ করে রাজশাহী কর আপীল অঞ্চলে একটি লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগ পাওয়ার পর রাজশাহী কর আপীল অঞ্চলের কর্মকর্তাদের টনক নড়ে।
ওই অভিযোগে বলা হয়, মো. হিমেল কাওসার বীর মুক্তিযোদ্ধা হেমাজ উদ্দিনকে (পরিচিতি নম্বর-০১৮১০০০২৬২৭, বেসামরিক গেজেট-৩৯৭) নিজের আপন দাদা পরিচয় দিয়ে সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক-কাম-কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরি নিয়েছেন। তিনি ২০১৩ সালের ২২ মে রাজশাহী কর আপীল অঞ্চলে সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক-কাম-কম্পিউটার অপারেটর পদে যোগদান করেন।
অভিযোগ সত্যতা যাচাই ও সরেজমিন তদন্ত করতে রাজশাহী কর আপীল অঞ্চলের অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার আয়েশা বিনতে মিজানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তদন্তে মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদে মো. হিমেল কাওসার চাকরি নেওয়ার সত্যতা পাওয়া যায়। গত ২৮ সেপ্টেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন রাজশাহী কর আপীল অঞ্চলের কমিশনারের দাখিল করেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী মো. হিমেল কাওসারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ৩০ সেপ্টেম্বর রাজশাহী কর আপীল অঞ্চলের কমিশনার মুন্সী হারুনর রশীদ এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে তদন্ত প্রতিবেদনটি পাঠান।
তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, হিমেল কাওসারের পিতা মো. আসির উদ্দিন বীর মুক্তিযোদ্ধা হেমাজ উদ্দিনের পুত্র নন। আসির উদ্দিনের পিতা মৃত সোলাইমান শেখ। উপজেলা প্রশাসন ও নির্বাচন অফিসের দেওয়া তথ্যানুসারে মো. হিমেল কাওসারের দাদা হেমাজ উদ্দিন নয়, সোলাইমান শেখ। হেমাজ উদ্দীন হচ্ছেন সোলাইমান শেখের আপন ভাই। অর্থাৎ হিমেল কাওসারের দাদার ভাই হচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা হেমাজ উদ্দীন। যাকে তিনি নিজের দাদা হিসাবে দেখিয়ে চাকরি নিয়েছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা হেমাজ উদ্দিনের চার পুত্র ও চার কন্যা সন্তান রয়েছে। যাদের নাম হচ্ছে জয়নাল আবেদীন, আকবর আলী, আশরাফুল ইসলাম, আনোয়ার হোসেন, নূরজাহান, মনোয়ারা, আনোয়ারা ও নাজনীন।
কেন দাদার ভাইকে নিজের দাদা দেখিয়েছেন এ বিষয়ে মো. হিমেল কাওসারকে কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করে জবাব দিতে বলা হলেও তিনি জবাব দেননি। এমনকি সময়ের জন্যও আবেদন করেননি তিনি। অর্থাৎ তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য নাই। অর্থাৎ মো. হিমেল কাওসার রাজশাহী কর আপীল অঞ্চলে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক-কাম-কম্পিউটার অপারেটর পদে সরকারি চাকুরি নিয়েছিলেন। সেজন্যই রাজশাহী কর আপীল অঞ্চলের ওই কর্মচারীর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার দিক নির্দেশনা চেয়ে এনবিআর চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করেছেন কর কমিশনার মুন্সী হারুনর রশিদ।
শুধু তাই নয় তদন্তে উঠে এসেছে সাবেক কর কমিশনার (পরে এনবিআর সদস্য হিসেবে অবসরে যাওয়া) খন্দকার মো. ফেরদৌস আলম রাজশাহী কর আপীল অঞ্চলে কর্মরত থাকাবস্থায় এই নিয়োগ কমিটির প্রধান ছিলেন। তার সুপারিশেই মো. হিমেল কাওসারকে মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদে চাকরি পান। ওই সময়ে রাজশাহী কর আপীল অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরির একটি কোটা ছিল। সেই কোটায় আগে থেকে একজন সেখানে কর্মরত ছিলেন। কোটা না থাকার পরও মুক্তিযোদ্ধা কোটায় মো. হিমেল কাওসারকে অবৈধভাবে চাকরি দেওয়া হয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে মো. হিমেল কাওসারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে এনবিআরের আয়কর বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ভুল তথ্য দিয়ে চাকরি নেওয়া হলে তা তদন্তে প্রমাণিত হলে চাকরি থাকার কথা নয়। তবে চাকরি হওয়ার পরপরই চাকরি প্রার্থীর সব তথ্য যাচাই করার কথা। এই কর্মচারী ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ দিয়ে চাকরি নিয়েছেন। এই নিয়োগের সঙ্গে যারা জড়িত, তারা নিশ্চয় ভালোভাবে যাচাই করেনি। অথবা নিয়োগের সঙ্গে জড়িত কেউ কোন না কোন উপায়ে এই কর্মচারীকে চাকরি দিয়েছেন। এনবিআরের উচিত হবে প্রথমে এই কর্মচারীকে শুধু চাকরিচ্যুত নয়, তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা। একই সঙ্গে নিয়োগের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
আর রাজশাহী কর অঞ্চলের কমিশনার মুন্সী হারুনর রশিদ বলেন, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদে চাকরি নেওয়ার বিষয়টি তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। কিন্তু চাকরি বিধিতে এ বিষয়ে কিছু বলা না থাকায় কোনো ব্যবস্থা নিতে পারিনি। সে কারনে নির্দেশনা পেতে এনবিআরে তদন্ত প্রতিবেদন পাঠিয়েছি। এখন এনবিআর আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিবে।