ঢাকার গুলশানে অফিস। আছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। চীনের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগ। মৌলভীবাজারে পাঁচতারকা হোটেলের নির্মাণ প্রকল্প চলছে। উপদেষ্টা হিসেবে চাকরি। পরে বিনিয়োগের প্রস্তাব। ৮২ লাখ ২০ হাজার টাকা বিনিয়োগের পর জানা গেছে এর সবকিছু ভুয়া।
সম্প্রতি এই চক্রের হাতে প্রতারণার শিকার হয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন। গুলশান থানায় মামলা করেছেন। প্রতারক চক্রের পাঁচজনকে গত ২৮ আগস্ট গুলশানের নিকেতন থেকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দ পুলিশ (ডিবি)। তাদের কাছ থেকে তিন লাখ ১৫ হাজার টাকা ও পাঁচটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়েছে।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন– মাদারীপুরের শহিদুল ইসলাম শাহিদ (৫৫), শরীয়তপুরের সনজ সাহা ওরফে উজ্জ্বল চৌধুরী (৫৬), ফরিদপুরের মহিউদ্দিন মাতুব্বার (৫৫), দিনাজপুরের মোশারফ হোসেন (৬৪) ও মো. শাহজাহান (৪৬)।
মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, চক্রের পাঁচ সদস্য গ্রেপ্তারের আগে আরও দুজন সচিবকে ফাঁদে ফেলতে কাজ করছিলেন। তাদের চক্রের হোতা সাবেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম শাহিদ। তাঁর আট থেকে ১০ সহযোগী রয়েছে। প্রতারণার কাজে যাদের তিনি বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করাতেন।
ডিবি গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, গুলশান থানায় এক ভুক্তভোগীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতারক চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। এই চক্রের অন্য সদস্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। গ্রেপ্তার আসামিরা কারাগারে রয়েছেন।
তিনি বলেন, চক্রের হোতা শহিদুল ইসলাম শাহিদের নামে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় ১০টি প্রতারণার মামলা রয়েছে। এ ছাড়া সনজ সাহার বিরুদ্ধে আটটি এবং মহিউদ্দিন মাতুব্বারের বিরুদ্ধে একটি প্রতারণার মামলা রয়েছে।
যেভাবে প্রতারণার ফাঁদে পড়েন ভুক্তভোগী
ভুক্তভোগী কাজী ওয়াছি উদ্দিন সমকালকে বলেন, গত ১৪ জুলাই রাতে ব্রাদার্স গ্রুপ অব কোম্পানির এমডি পরিচয়ে ইঞ্জিনিয়ার মোস্তাফিজুর (শহিদ) ফোন করেন। তিনি জানান, চীনের সঙ্গে তাদের কোম্পানির যৌথ বিনিয়োগ রয়েছে। মৌলভীবাজারে পাঁচতারকা হোটেলের নির্মাণ প্রকল্প চলছে। এতে উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতে হবে। পরদিন সকালে গুলশান ১-এর ৭ নম্বর সড়কের ৫/বি ভবনের এ/১ অফিসে যেতে বলেন। তাঁর কথা মতো অফিসে যান। সেদিন তাদের সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করে বেরিয়ে আসেন। তাঁর (শহিদ) জরুরি কাজ থাকায় অন্য কথা হয়নি।
তিনি বলেন, ১৬ জুলাই আবারও তাদের অফিসে যেতে বলেন ইঞ্জিনিয়ার মোস্তাফিজুর। সেদিন তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলার সময় রাজ্জাক (সনজ সাহা) আসেন। তাদের মধ্যে কথাবার্তা চলার এক পর্যায়ে ইঞ্জিনিয়ার মোস্তাফিজুরকে ব্যবসায়িক প্রস্তাব দেন রাজ্জাক। তিনি (রাজ্জাক) জানান, আমদানিকারকের কাছ থেকে ঘড়ি কিনে ভারতীয় কোম্পানির কাছে বেচলে ১৫-২০ শতাংশ লাভ থাকবে। রাজ্জাক চলে যাওয়ার পর মোস্তাফিজুর বলেন, তিনি (রাজ্জাক) ভারতীয় একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন। ওই কোম্পানির ঢাকায় দুটি ঘড়ির শোরুম রয়েছে। তারা সুইজারল্যান্ড থেকে ঘড়ি আমদানি করেন। এর ২০ শতাংশ বাংলাদেশে এবং ৮০ শতাংশ ঘড়ি ভারতে বেচেন। এই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করলে ভালো লাভ থাকবে।
কাজী ওয়াছি উদ্দিন জানান, এর আধা ঘণ্টার মধ্যে রাজ্জাক আমদানিকারক পরিচয়ে ইব্রাহিমকে (মহিউদ্দিন) সঙ্গে নিয়ে আসেন। তিনি ঘড়ির ক্যাটালগ দেখালে মোস্তাফিজুর সেটা পছন্দ করেন। বিনিয়োগ করতে রাজি হন। এরপর তারা ওয়াছি উদ্দিনকে তাদের ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে বলেন। প্রথমে রাজি হননি। একাধিকবার বলার পর দুই লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে রাজি হন। এর পর আরও টাকা বিনিয়োগ করার জন্য চাপাচাপি করতে থাকেন। ঘড়ি ক্রেতাকে পৌঁছানোর পর টাকা ফেরত দেবেন বলে জানান। এ সময় তাঁর কথা ফেলতে না পেরে আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধারদেনা করে আরও ৮০ লাখ টাকা দেন। সর্বশেষ ২৯ জুলাই তাদের টাকা ফেরত দেওয়ার কথা ছিল। এরপর থেকে আত্মগোপনে চলে যান অভিযুক্তরা। ওই ঠিকানায় গিয়ে তাদের অফিস বন্ধ পাওয়া যায়।
ডিবি গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) তানভীর হাসান বলেন, চক্রের হোতা শহিদুল ইসলাম শহিদ নিজেকে ইঞ্জিনিয়ার মোস্তাফিজুর রহমান ওরফে মাহমুদুর রহমান, সনজ সাহা ওরফে উজ্জ্বল চৌধুরী নিজেকে আব্দুর রাজ্জাক, মহিউদ্দীন মাতুব্বার নিজেকে বিদেশি ক্রেতা মো. ইব্রাহিম হিসেবে পরিচয় দিতেন।