রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানার মামলায় দ্বিতীয় দফায় সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। শুক্রবার (২৭ জুন) প্রথম দফার রিমান্ড শেষে পাঁচ কারণ উল্লেখ করে ফের ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আওলাদ হোসাইন মুহাম্মদ জোনাইদের আদালত রিমান্ডের আদেশ দেন। তবে শুনানি চলাকালে পৌনে এক ঘণ্টা কাঠগড়ায় তাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখা গেছে। তার চোখেমুখে ছিল বিষন্ন ও হতাশার ছাপ।
এদিন দুপুর আড়াইটায় তাকে পুলিশ পাহারায় আদালতে হাজির করা হয়। এরপর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও শেরেবাংলা নগর থানার উপপরিদর্শক শামসুজ্জোহা সরকার পাঁচটি কারণ উল্লেখ করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। সেখানে উল্লেখ করেন, আসামির প্রদানকৃত চাঞ্চল্যকর তথ্যাদি যাচাই বাছাই করা; আসামি যে তথ্য গুলো প্রদান করেছেন সেগুলো নথি সংক্রান্ত তথ্য হওয়ায় এ নথি সমূহ উদ্ধার পূর্বক যাচাই বাছাই করা; আসামি প্রধান নির্বাচন কমিশনার থাকা কালে যেহেতু ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন একটি পাতানো নির্বাচন ছিল সেহেতু সেটি একটি দাপ্তরিক সংঘবদ্ধ অপরাধ।
আসামির নির্দেশে অন্যান্য অফিসের সাথে যোগাযোগ করে কিভাবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি পাতানো নির্বাচন করে তা উদঘাটন; ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর্থিক বাজেট ও বাস্তবায়ন সংক্রান্ত তথ্য উদঘাটন করা; আসামি কে.এম নুরুল হুদা ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সাথে জড়িত অন্যান্য পলাতক আসামিদের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করেছে। পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারসহ জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। পরে বেলা ৩ টা ৪০ মিনিটে হেলমেট, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও হাতকড়া পরিয়ে কাঠগড়ায় তোলা হয়। পৌঁনে ৪ টায় রিমান্ড শুনানি শুরু হয়।
শুনানিতে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, এটা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ মামলা। আসামি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান ছিলেন। আসামি নুরুল হুদাসহ সাবেক তিন সিইসির কারণে ফ্যাসিস্টের জন্ম হয়। মানুষ গুম, খুনের শিকার হয়। সর্বশেষ জুলাই অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্টদের বিদায় হয়েছে।
রিমান্ডে নিয়ে নুরুল হুদাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো এতো বড় কর্মযজ্ঞের বিষয়ে এতো অল্প সময়ে জানা খুবই কঠিন ব্যাপার। জিজ্ঞাসাবাদে আসামি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে। তবে তদন্তে সহযোগিতা করতে চান না। এজন্য বারবার রিমান্ড প্রয়োজন হবে।
তিনি আরো বলেন, ২০১৮ সালে যখন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হয়। তখন পুলিশ, প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকে। জেলা পর্যায়ে বিচারকদের নিয়ে অনুসন্ধান কমিটি গঠনের ক্ষমতা থাকে। তবে ওই সময় বিরোধী রাজনৈতিক দলকে আওয়ামী লীগ পিটিয়ে রাজপথ ছাড়া করেছে। প্রার্থীদের বাড়িঘর ভাঙচুর, লুটপাট করা হলেও সেই বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ২০১৮ সালের প্রহসনের ভোট করেন। রাত ৩ টার মধ্যে ২০০ আসনের প্রার্থীকে বিজয় ঘোষণা করেন।
পাবলিক প্রসিকিউটর বলেন, রাতের ভোট করার বিষয়ে প্রিজাইডিং অফিসারকে নির্দেশ দেওয়ার বিষয়ে জানা প্রয়োজন। এছাড়া কাদের সহযোগিতায় রাতের ভোট সম্পন্ন হয়েছে। পাতানো নির্বাচনের নির্দেশগুলো কিভাবে পরিচালিত হয়েছিল সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন। নির্বাচনের সময় শেখ হাসিনার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করার বিষয় জানা দরকার। এজন্য তার ১০ দিনের রিমান্ড প্রার্থনা করছি।
রিমান্ড বাতিল ও জামিন চেয়ে আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম সজীব শুনানিতে বলেন, আগের রিমান্ড আবেদনের সঙ্গে আজকের আবেদনে মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। নতুন করে মামলায় ধারা সংযোজন করা হয়েছে। নুরুল হুদা তো সরকারের প্রতি রাষ্ট্রদ্রোহ করেনি। এই মামলা চলার ক্ষেত্রে বাধা রয়েছে। আইনগত মামলাটি একেবারেই ত্রুটিপূর্ণ। তদন্ত কর্মকর্তার ধারা সংযোজনের সুযোগ নেই।
তিনি আরো বলেন, নুরুল হুদার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট, সুস্পষ্ট, দায় সৃষ্টিকারী কোন তথ্য উপাত্ত নেই। রিমান্ডে নিয়ে তদন্তে অগ্রগতি নেই। রিমান্ড চাওয়ার ক্ষেত্রে যে সকল তথ্য উপাত্ত এখানে উল্লেখ করা হয়নি। রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা ব্যক্তি হিসেবে করা প্রশ্নবিদ্ধ। এখানে সরকার বাদী হয়ে মামলা করবে। এর আগে ২২ জুন নুরুল হুদাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরদিন ২৩ জুন তাকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। শুনানি শেষে ওইদিন আদাতার চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ মামলায় গ্রেপ্তার সাবেক সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল রিমান্ডে রয়েছে। গত ২৫ জুন আদালত তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
গত ২২ জুন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব ‘পালন না করে’ উল্টো ‘ভয়-ভীতি দেখিয়ে’ জনগণের ভোট ছাড়াই নির্বাচন সম্পন্ন করার অভিযোগে মামলা করে বিএনপি। পরবর্তীতে গত ২৫ জুন এ মামলায় নতুন করে রাষ্ট্রদ্রোহ, প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের ধারা যুক্ত করা হয়। মামলায় ২০১৪ সালের নির্বাচনের তৎকালীন সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, ২০১৮ সালের নির্বাচনে তৎকালীন সিইসি এ কে এম নূরুল হুদা ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের তৎকালীন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার, এ কে এম শহীদুল হক, জাবেদ পাটোয়ারী, বেনজির আহমেদ ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকেও আসামি করা হয়েছে এই মামলায়।
মামলায় অভিযোগ বলা হয়েছে, ওই তিন নির্বাচনে ‘গায়েবী মামলা, অপহরণ, গুম খুন ও নির্যাতনের’ ভয় দেখিয়ে, বিএনপি নেতাকর্মীদের ‘গণগ্রেপ্তার’ করে নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখা হয়। সংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে থাকা সত্বেও সংবিধান লঙ্ঘন, নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন, সরকারি কর্মচারী হয়েও অবৈধভাবে ভোটে হস্তক্ষেপ, ভয়ভীতি দেখিয়ে ভোটের কাজ সম্পূর্ণ করা ও জনগণের ভোট না পেলেও সংসদ সদস্য হিসেবে মিথ্যাভাবে বিজয়ী ঘোষণা করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এ ঘটনার সাক্ষী সকল ভোট কেন্দ্র এলাকার ভোটাররা এবং ভোটারদের মধ্যে যারা ভোট প্রদান করতে বঞ্চিত হয়েছেন তারাসহ ভোট কেন্দ্রে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্যরা। এছাড়া ভোট কেন্দ্রে অনেক সৎ প্রিজাইডিং অফিসার, পুলিশ অফিসারসহ স্থানীয় লোকজনসহ আরো অন্যান্যরা ঘটনার সাক্ষী হবে। এছাড়া ব্যালট পেপারে যে সিল ও স্বাক্ষর রয়েছে, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেই প্রকৃতভাবে তারা ভোট দিয়েছে কিনা সে বিষয়ে উল্লেখিত ঘটনার সঠিক রহস্য তদন্তে সত্য উদঘাটিত হবে।